দিব্যেন্দু মজুমদার– ১৯৩০ সালে যখন হুগলিতে স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল ঠিক সেই সময় বলাগড়ের মহীপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কামারপাড়া গ্রামের বৃন্দাবন পল্লীতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ২০০ বছরের রথযাত্রা। গ্রামের বহু মানুষ সেই সময় স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। মানুষ ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন তাদের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা। তারপর কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেই রথেরও অস্তিত্ব আজ আর নেই। মঙ্গলবার সবার নজর যখন মাহেশ ও পুরীর রথযাত্রার দিকে তখন পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনে পুনরায় নতুন করে শুরু হল এই রথযাত্রা। তাই বলাগড়ের মহীপালপুরের মানুষ আজ তাদের সেই ঐতিহ্যের রথযাত্রা ফিরিয়ে আনতে পেরে রীতিমতো খুশির জোয়ারে ভাসল। আর জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই রথযাত্রাকে সামনে রেখে রথের নামকরণ করা হয়েছে মহামিলন রথ।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য উৎসবটা বড় নয় এর পিছনের ইতিহাসটা অনেক দীর্ঘ যা ব্রিটিশদের অত্যাচারের ভয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজকে সেই ইতিহাসকে স্মরণ করে উৎসবের আনন্দে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত বর্ণের মানুষ যেভাবে মেতে উঠেছেন তাতে তারা রীতিমতো খুশি। প্রায় ৯০ বছর বাদে বন্ধ হয়ে যাওয়া রথযাত্রা নতুন করে চালু হওয়াকে কেন্দ্র করে রীতিমতো উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় গ্রামবাসীদের মধ্যে। বলাগড়ের মহীপালপুর কামারপাড়া- বৃন্দাবন পল্লী একটি অতি প্রাচীন জনপদ হিসেবে পরিচিত। এক সময় এই গ্রামে রথযাত্রা ছিল তাদের মূল উৎসব। সেই সময় গুপ্তিপাড়া মঠের অধীন ছিল এই কামারপাড়া গ্রাম। এই গ্রামে ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর হাত ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। গ্রামের মানুষ সেদিন ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতার যুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং ব্রিটিশদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সেই সময় এই রথযাত্রার রশি ধরে টান মারার মত লোক ছিল না। ফলে বন্ধ হয়ে যায় রথযাত্রা।
দীর্ঘ সময় এই রথযাত্রা বন্ধ থাকার পর বলাগড়ের অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় নতুন করে এই রথযাত্রার ইতিহাস অন্বেষণ শুরু করেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন গ্রামের পুকুরের তলা থেকে পুরোনো সেই রথের চাকা উদ্ধার হয়েছে। তারপর থেকেই এখানকার পুরনো দিনের মানুষেরা ভীষণ আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন এই রথযাত্রা নিয়ে। আসলে এটা হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি উদ্ধারের আর একটা দিক যা সভ্যতার ইতিহাসকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে। এই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে উদ্ধারের পরই গ্রামেরই মাধব ব্যানার্জী সহ অন্যান্যরা রথযাত্রা পুনরায় চালু করার বিষয়ে উদ্যোগী হন। ইতিহাস গবেষক পার্থবাবু বলাগড়ের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক নীলাদ্রি সরকার সহ বিভিন্ন প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন রথযাত্রা প্রসঙ্গে। এরপর প্রশাসনিক অনুমতি পাওয়ার পরই শুরু হয়ে যায় রথযাত্রার প্রস্তুতি।
গ্রামের গান্ধী ঘরের কাছে গত দুই মাস ধরে তৈরি হয় নয় চূড়া বিশিষ্ট ২২ ফুট উচ্চতার এই রথ। তৈরি হয় নিম কাঠের জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি। বিদায়ী গ্রাম প্রধান সৌরভ বিশ্বাস বলেন প্রায় ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই রথ তৈরি হলেও এর সিংহভাগ খরচ বহন করেছেন গ্রামবাসীরা। এদিন সেই রথেরই রশিতে টান মেরে রথযাত্রার শুভ উদ্বোধন করেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর মেয়েরা। এই গ্রামেতেই আদিবাসী, কৌম, দুর্লভ, ব্রাহ্মণ সহ সমস্ত শ্রেণীর বাস। তাই সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি এই রথের নাম রাখা হয়েছে মহামিলন রথ। আর মঙ্গলবার সেই রথ যাত্রার মধ্যে দিয়েই মহামিলন উৎসবে মেতে উঠলেন গ্রামবাসীরা।